বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে অনেকেই সমাজের উন্নয়নে কাজ করতে চান। কিন্তু একটি সংগঠন তৈরি করতে গেলে শুধু কিছু লোক আর উদ্দেশ্য থাকলেই হয় না — লাগে একটি সুশৃঙ্খল গঠনতন্ত্র। এটি একটি সংগঠনের আইনগত রূপরেখা যা সংগঠনের কাঠামো, নিয়মনীতি ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে।
এই আর্টিকেলে আমরা জানব, একটি আদর্শ সামাজিক সংগঠনের গঠনতন্ত্র কেমন হওয়া উচিত, কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, এবং একটি ডাউনলোডযোগ্য খসড়া নমুনাও পাবেন।
🧾 গঠনতন্ত্র কী ও কেন প্রয়োজন?
গঠনতন্ত্র হল একটি সংগঠনের লিখিত নিয়ম-কানুন যা প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্যদের অনুসরণ করতে হয়।
এই নথি ছাড়া আপনি সংগঠনকে আইনি ভাবে রেজিস্ট্রেশন করাতে পারবেন না।
গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা:
- সংগঠনের কাঠামো স্পষ্ট করা
- সদস্যদের দায়িত্ব নির্ধারণ
- ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা আনা
- সরকারি অনুমোদন/রেজিস্ট্রেশনে সহায়ক
🧱 একটি আদর্শ সামাজিক সংগঠনের গঠনতন্ত্রে যা যা থাকা উচিত
নিচে ধারাবাহিকভাবে গঠনতন্ত্রের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরা হলঃ
১. সংগঠনের নাম ও ঠিকানা
- পূর্ণ নাম (বাংলা ও ইংরেজি উভয়ে)
- অফিসের স্থায়ী ঠিকানা
২. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য কী?
- কোন শ্রেণির মানুষের জন্য কাজ করবে?
- কোন কোন এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করবে?
৩. সদস্যপদের নিয়ম
- সদস্য হতে যোগ্যতা
- সদস্য হবার পদ্ধতি
- সদস্যের অধিকার ও দায়িত্ব
- সদস্য পদ বাতিলের নিয়ম
৪. সংগঠনের গঠন ও কমিটি
- কত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হবে
- সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ ইত্যাদি পদ
- কমিটির মেয়াদ
- নির্বাচন পদ্ধতি
৫. সাধারণ সভা ও বিশেষ সভা
- সভার আয়োজন কবে হবে?
- সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ম
- কোয়ারাম পূর্ণ হওয়ার শর্ত
৬. অর্থনীতি ও হিসাবরক্ষণ
- অনুদান ও চাঁদা সংগ্রহের নিয়ম
- ব্যাংক হিসাব পরিচালনা
- হিসাবের স্বচ্ছতা ও নিরীক্ষা
৭. গঠনতন্ত্র সংশোধন
- কোন অবস্থায় গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা যাবে?
- কতজন সদস্যের সম্মতি লাগবে?
৮. ভাঙন ও বিলুপ্তির নিয়ম
- সংগঠন বন্ধ হলে সম্পদ কোথায় যাবে?
📝 গঠনতন্ত্র তৈরির নিয়ম (ধাপে ধাপে)
- প্রাথমিক আলোচনা: প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে খসড়া তৈরি
- লিখিত খসড়া প্রস্তুত: উপরের বিষয়সমূহ অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে লিখুন
- সাধারণ সভায় অনুমোদন: খসড়াটি সদস্যদের সম্মতিতে পাস করান
- আইনজীবীর পরামর্শ নিন: প্রয়োজনে সংশোধন করে চূড়ান্ত করুন
- রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিন (যেমন: সমাজসেবা অধিদপ্তর বা NGO Affairs Bureau)
📥 সামাজিক সংগঠনের গঠনতন্ত্র খসড়া (নমুনা)
১. সংগঠনের নাম:
“জনসেবা সমাজ কল্যাণ সংস্থা”
(ইংরেজিতে: Janasheba Social Welfare Organization)
২. কার্যালয়:
গ্রাম: [……..], ডাকঘর: [……..], উপজেলা: [……..], জেলা: [……..], বাংলাদেশ।
৩. সংস্থার প্রকৃতি:
এটি একটি অ-লাভজনক, অ-রাজনৈতিক এবং অ-ধর্মভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠন।
৪. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
- সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করা।
- মাদক, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা।
- বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করা।
- দুর্যোগকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- যুব ও নারীদের আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদান।
৫. সদস্যপদের ধরণ ও যোগ্যতা:
সদস্য ধরণ:
- সাধারণ সদস্য
- আজীবন সদস্য
- সম্মানিত সদস্য
যোগ্যতা:
- ন্যূনতম ১৮ বছর বয়স
- স্বপ্রণোদিতভাবে সামাজিক উন্নয়নে আগ্রহী
- কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত নয়
৬. সদস্যপদ গ্রহণের নিয়ম:
- লিখিত আবেদনপত্র পূরণ করে নির্বাহী কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে সদস্যপদ প্রদান।
- সদস্য ফি (যেমন: মাসিক ৫০ টাকা) পরিশোধ বাধ্যতামূলক।
৭. সদস্যপদ বাতিলের নিয়ম:
- নিয়মিত ফি পরিশোধে ব্যর্থ হলে
- সংগঠনের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করলে
- কমিটির ২/৩ ভোটে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত
৮. সংগঠনের কাঠামো ও নির্বাহী কমিটি:
- মোট সদস্য: ৯ জন
- পদের নাম:
- সভাপতি
- সহ-সভাপতি
- সাধারণ সম্পাদক
- যুগ্ম সম্পাদক
- কোষাধ্যক্ষ
- সাংগঠনিক সম্পাদক
- দপ্তর সম্পাদক
- সমাজকল্যাণ সম্পাদক
- মহিলা বিষয়ক সম্পাদক
কমিটির মেয়াদ:
২ (দুই) বছর
নির্বাচন পদ্ধতি:
গোপন ব্যালটে সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন
৯. সভার নিয়মাবলী:
- সাধারণ সভা: বছরে অন্তত ১ বার
- নির্বাহী সভা: ৩ মাস অন্তর
- জরুরি সভা: প্রয়োজনে সভাপতি আহ্বান করবেন
- কোয়ারাম: কমপক্ষে ৫ জন সদস্য উপস্থিত থাকতে হবে
১০. আয়-ব্যয়ের উৎস ও হিসাবরক্ষণ:
- সদস্য চাঁদা, অনুদান, ফান্ডিং
- ব্যাঙ্কে সংগঠনের নামে হিসাব
- সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ যৌথভাবে চেক পরিচালনা করবেন
- বছরে একবার নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক
১১. গঠনতন্ত্র সংশোধন:
- সদস্যদের ২/৩ ভোটে সংশোধন অনুমোদনযোগ্য
- সংশোধিত কপি রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে
১২. সংগঠন বিলুপ্তির নিয়ম:
- ৩/৪ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সম্মতিতে বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত
- সংগঠনের সম্পদ সমাজসেবামূলক কাজে দান করা হবে
১৩. চূড়ান্ত ঘোষণা:
এই গঠনতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ও অনুমোদিত হয়।
তারিখ: …………………
সভাপতির নাম ও স্বাক্ষর
সাধারণ সম্পাদকের নাম ও স্বাক্ষর
কোষাধ্যক্ষের নাম ও স্বাক্ষর
অন্যান্য সদস্যদের স্বাক্ষর
⚠️ সাধারণ ভুল এবং পরামর্শ
ভুল | করণীয় |
---|---|
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অস্পষ্ট | পরিষ্কারভাবে সমাজসেবা ভিত্তিক উদ্দেশ্য লিখুন |
সদস্যপদ নিয়ম না থাকা | যোগ্যতা ও বাতিলের নিয়ম লিখুন |
গঠনতন্ত্রে স্বাক্ষর না রাখা | সব প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের স্বাক্ষর থাকা আবশ্যক |
সরকারি নীতিমালার সাথে না মেলানো | NGO বা সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুসরণ করুন |
🔚 উপসংহার
একটি সামাজিক সংগঠন সফলভাবে পরিচালনার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য, আইনি ও কার্যকর গঠনতন্ত্র অপরিহার্য। উপরের এই গঠনতন্ত্রের খসড়া এবং নির্দেশনা আপনার সংগঠন গঠনে সহায়ক হবে বলে আমরা আশা করি।
আপনি চাইলে এই আর্টিকেলটি শেয়ার করে অন্যদেরও সাহায্য করতে পারেন। এবং যদি আপনার সংগঠনের জন্য কাস্টম গঠনতন্ত্র তৈরি করতে চান, তাহলে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
❓ FAQ: আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর
উত্তর: হ্যাঁ, তবে ভালো বোঝাপড়ার জন্য পরামর্শ নেওয়া ভালো।
উত্তর: না, প্রয়োজন অনুযায়ী সদস্যদের অনুমতিতে সংশোধন করা যায়।
উত্তর: না, খসড়া অনুমোদন ও অন্যান্য কাগজপত্রসহ আবেদন করতে হয়।

আমি একটি কোম্পানির পাবলিক রিলেশনশিপ অফিসার হিসাবে কর্মরত আছি। আমার কর্মক্ষেত্রে সরাসরি জনগনের সাথে ডিল করার তাই আমি পাবলিকলি অনেক বক্তব্য দেওয়ার প্রয়োজন পরে। তাছাড়াও বক্তব্য দেওয়া ও শোনাকে আমি বেশ উপভোগ করি।