সামাজিক সংগঠনের কমিটি গঠনের নিয়ম

Spread the love

একটা সময় ছিল, যখন আমি নিজেই জানতাম না “একটা সামাজিক সংগঠনের কমিটি গঠন করা মানে আসলে কী?” কিন্তু সময়ের সঙ্গে, যখন নিজেই একটি সমাজসেবামূলক সংগঠনের নেতৃত্ব নিতে এগিয়ে এলাম, তখন বুঝলাম এটা শুধু নাম-লেখা বা কিছু পদ বণ্টনের ব্যাপার না; এটা আসলে একটি দায়িত্বপূর্ণ, গণতান্ত্রিক, এবং হৃদয় থেকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার সূচনাবিন্দু।

আজ আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা আর কিছু কার্যকর নিয়ম-কানুন আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। যেগুলো অনুসরণ করে আপনি গঠন করতে পারেন একটি কার্যকর, স্বচ্ছ ও সমাজবান্ধব কমিটি।

🔶 কেন কমিটি দরকার?

একটি সংগঠন চলবে কীভাবে, সিদ্ধান্ত কে নেবে, কে কোন কাজ করবে। এই সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে থাকে একটি ভালোভাবে গঠিত কমিটির মধ্যেই। কমিটি মানে শুধু নেতৃত্ব না; কমিটি মানে একটা দল যারা ভিন্নমত হলেও এক লক্ষ্য নিয়ে একসাথে হাঁটে।

🔷 কমিটি গঠনের পূর্ব প্রস্তুতি

আমি প্রথম যেদিন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিই, সেদিনই সবচেয়ে বড় শিক্ষা পাই গঠনতন্ত্র ছাড়া আপনি পথচলা শুরুই করতে পারবেন না। তাই শুরুতেই যা করা জরুরি:

১. গঠনতন্ত্র (Constitution) তৈরি করুন

  • সংগঠনের উদ্দেশ্য, সদস্যদের অধিকার ও দায়িত্ব, নির্বাচন পদ্ধতি সব স্পষ্টভাবে লিখুন।
  • সময়ের সাথে আপডেট করার সুযোগ রাখুন।

🔷 কমিটি গঠনের ধাপগুলো

২. সাধারণ সভা ডাকুন

একটা inclusive সাধারণ সভা ডাকুন, যেখানে সবাই মতামত দিতে পারবে। এটি গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ।

৩. পদ নির্ধারণ করুন

সাধারণত কমিটিতে যেসব পদ থাকে:

  • সভাপতি
  • সহ-সভাপতি
  • সাধারণ সম্পাদক
  • কোষাধ্যক্ষ
  • সাংগঠনিক সম্পাদক
  • সদস্যরা

সংগঠনের ধরন অনুযায়ী পদ কম-বেশি হতে পারে।

🔶 সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি

আমার অভিজ্ঞতায়, দুই ধরনের পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়:

ক) নির্বাচনের মাধ্যমে

  • মনোনয়ন, প্রচারণা, ভোট সব হয় স্বচ্ছভাবে।
  • একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন বা তত্ত্বাবধায়ক রাখা জরুরি।

খ) ঐকমত্যের ভিত্তিতে (Consensus)

  • সবাই মিলে আলোচনার মাধ্যমে নেতৃত্ব ঠিক করে নেয়া হয়।
  • ছোট সংগঠনে বা শুরুতে এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর।

🔷 যোগ্যতা ও শর্ত

আমরা আমাদের কমিটিতে একটি নিয়ম করেছিলাম। সদস্য হতে হলে তাকে হতে হবে সমাজসচেতন, নিরপেক্ষ ও জনকল্যাণে আন্তরিক।
এছাড়াও কিছু বাস্তব শর্ত দরকার হতে পারে:

  • ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত নয়
  • কর বা ঋণ খেলাপি নয়
  • সদস্যপদ মেয়াদ পূর্ণ হওয়া

🔷 কার্যক্রম পরিচালনার নীতিমালা

যদি আপনি একটি শক্তিশালী কমিটি চান, তাহলে আপনাকে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতেই হবে। আমরা যেগুলো অনুসরণ করতাম:

  • মাসিক মিটিং বাধ্যতামূলক
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বসম্মতি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট
  • প্রত্যেক সদস্যের মতামতের মূল্যায়ন
  • স্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদন
  • নির্দিষ্ট ভূমিকা নির্ধারণ

🔶 কমিটির স্তরভিত্তিক কাঠামো

আমাদের সংগঠন বড় হওয়ায়, আমরা কয়েকটি স্তরে কমিটি গঠন করি:

  • জাতীয় কমিটি
  • জেলা কমিটি
  • উপজেলা কমিটি
  • ইউনিয়ন/ওয়ার্ড কমিটি

প্রতিটি স্তরের নিজস্ব দায়িত্ব ও প্রতিবেদন পদ্ধতি থাকে।

🔷 মেয়াদকাল ও পুনর্গঠন

কমিটির মেয়াদ আমরা নির্ধারণ করেছিলাম ২ বছর।

  • মেয়াদ শেষে নির্বাচন/পুনর্নিয়োগ
  • পুরাতন কমিটি নতুন কমিটিকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে

এতে করে ধারাবাহিকতা থাকে এবং নতুন নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি হয়।

🔶 আইনি রেজিস্ট্রেশন (প্রয়োজনে)

যদি আপনি সংগঠনটিকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে চান, তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর বা NGO Affairs Bureau-তে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কমিটির তালিকা ও গঠনতন্ত্র জমা দিতে হবে।

🔚 উপসংহার: নেতৃত্ব নয়, এটা একটি দায়িত্ব

একটা কমিটি গঠন মানে নেতৃত্ব গ্রহণ নয়, বরং সেবা করার দায়িত্ব নেওয়া।

আমি নিজে যেটা উপলব্ধি করেছি, তা হলো একটি কমিটি তখনই সফল হয়, যখন সেখানে নেতৃত্ব থাকে সম্মিলিত, সিদ্ধান্ত হয় স্বচ্ছ আর সদস্যরা হয় দায়বদ্ধ।

তাই আপনি যদি নতুন করে কমিটি গঠন করতে চান, তাহলে শুধু নিয়ম নয় মানবিকতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ-এর দিকগুলোও গুরুত্ব দিন।

Leave a Comment